স্বদেশ ডেস্ক:
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তাঁর রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তী সময়ে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে। এখনো হাট বসে সেখানে।
কটিয়াদীর এই ঢাকের হাটের ইতিহাস ৪০০ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো। এ কারণে হাটটি জেলার সব ধর্মের মানুষের কাছে ইতিহাস–ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। হাট বসে দুর্গাপূজা ঘিরে। পঞ্চমী ও ষষ্ঠী হাটবার। এবারও একই নিয়ম মেনে পুরানবাজারে বসেছে ঢাকের হাট।
গতকাল শুক্রবার ছিল মহাষষ্ঠী। সরেজমিনে দেখা যায়, শেষ সময়ে পূজারিদের দেখা পেতে তখনো প্রায় ৪০টির মতো ঢাকি দল অপেক্ষায়। তাঁদের হাতে কাঁসর, সানাই, নানা বাঁশি, করতাল ও খঞ্জরি। কিছু সময় বিরতি দিয়ে দলভিত্তিক বাদ্য বাজাচ্ছেন তাঁরা। কারণ, কোন দলের কত মূল্য হবে, তা নির্ধারিত হয় উপস্থিত মুনশিয়ানা পরীক্ষার মাধ্যমে। বাজনার তালে নাচ আর নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ারও চেষ্টা করেন ঢাকিরা। বাজনার শব্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। যাঁদের সঙ্গে দরদাম মিলছে, তাঁদের অনুসরণ করে পিছু নেন ঢাকিরা।
শান্ত দাস একটি ঢাকি দলের নেতৃত্বে আছেন। দলের সদস্যসংখ্যা তিন। বাদ্য বলতে ঢাক, ঢোল আর করতাল। বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রয়পুরে। এক যুগ ধরে তিনি এই হাটে আসেন। গতকাল তাঁর দল ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে কটিয়াদীর ভোগপাড়ার একটি মণ্ডপে বাদ্য বাজাবেন বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
শান্ত দাস বলেন, ‘দেশের আর কোথাও ঢাকের হাট আছে বলে আমার জানা নেই। তাও আবার ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে থাকা হাট। হাটে আসা ছাড়াও মণ্ডপে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এখানে এলে অন্য ঢাকিদের সঙ্গে দেখা হয়। সুখ–দুঃখের কথা হয়।’
একসময় একটি ঢাকি দলে ঢাক, ঢোল, খঞ্জরি আর করতাল যথেষ্ট মনে করা হলেও এখন পেশায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ঢাকি দলে যুক্ত হয়েছে নানা আধুনিক বাদ্য। তেমনি একটি ঢাকি দলের নাম ‘লক্ষ্মী নারায়ণ ভ্যান পার্টি’। এই দলে সদস্য ছয়জন। দলটি হাটে আসে বৃহস্পতিবার। এসেছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক থেকে। একদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো মণ্ডপের সঙ্গে চুক্তি হয়নি। এ কারণে কিঞ্চিৎ মন খারাপ দলের সদস্যদের।
দলটির নেতা সচিন্দ্র দাস জানালেন, ‘আজ মহাষষ্ঠী। আনন্দময়ী মা দুর্গার আগমনী বার্তা রটে গেছে। মন্দির সজ্জাও শেষ। আজ প্রতিমার আসনে প্রতিস্থাপন। প্রতিমার আসনে প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত ঢাকে কাঠি না পড়লে চলে না। কিন্তু তাঁর দলের এখনো গতি হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত দরদাম হয়েছে। কিন্তু আমাদের ৮০ হাজার টাকা না হলে পোষাবে না।’
আয়োজক পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দুই দিনে তিন শতাধিক ঢাকির সমাগম ঘটে এই হাটে। এখানে ঢাক ছাড়া আর কিছু কেনাবেচা হয় না। ঢাকিদের সুবিধার জন্য দুই বছর আগে সাবেক সাংসদ সোহরাব উদ্দিন ৯ লাখ টাকা ব্যয় করে একটি শেড নির্মাণ করে দিয়েছেন। তবে নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
কটিয়াদী ইতিহাস–ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন রাজিব সরকার। সামাজিক সংগঠন ‘আশ্রয়’র এই প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনেক ঢাকি চুক্তিবদ্ধ হন মুঠোফোনে। ফলে কিছুটা হলেও হাটের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এ জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এর মধ্যে হাটে আসা ঢাকিদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
কটিয়াদী ঢাকের হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বেনি মাদব ঘোষ। তিনি জানালেন, পঞ্চমীর দিন ১৩৩টি ঢাকি দল চুক্তিবদ্ধ হয়ে হাট ছেড়েছে। সর্বোচ্চ ১ লাখ এবং সর্বনিম্ন হাজার টাকায় ঢাকিরা মণ্ডপে গেছেন। তবে কিছু ঢাকির জন্য মণ্ডপ মিলবে না। তাঁদের খাওয়াদাওয়া ও যাতায়াতের খরচ ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।